মহেরা জমিদার বাড়ি

১৮৯০ দশকের পূর্বে স্পেনের কর্ডোভা নগরের আদলে নির্মিত টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার অধীনে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন এই জমিদার বাড়িটি, ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইল জেলায় ৮ একর বিস্তৃত জায়গার উপর অবস্থিত মনোমুগ্ধকর মহেরা জমিদার বাড়ি। মিস্টার গ্রন্থাগার এর এই পর্বে আজ আপনাদের নিয়ে যাবো হাজারো ফুলের সৌরভে ডুবে থাকা ও চাঁদের আলোয় নিজের জৌলুস ফুটিয়ে তোলা সুবিশাল ও নান্দনিকতায় ঘেরা মহেড়া জমিদার বাড়িতে , জানাবো কি এমন চাপা কষ্ট ও অন্তরদহন নিয়ে তৎকালীন জমিদার রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী লৌহজং নদীর নৌপথ ধরে এ দেশ ছেড়ে চলে যান ।
ইতিহাসের ধূসর পৃষ্ঠায় চোখ রাখলে জানা যায় কৃষ্ণচরণ শাহ ও আনন্দ সাহা নামে দুই ভাই কলকাতা থেকে প্রচুর ধন-সম্পদ নিয়ে এই টাঙ্গাইল জেলার মহেড়া নামক গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন , জনশ্রুতি আছে এই দুই ভাই কলকাতায় লবণ ও ডালের ব্যবসা করে বিত্তবান হয়ে ওঠেন । খুব অল্প সময়ের মধ্যে কৃষ্ণচরণ শাহ ও আনন্দ সাহা গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য একটি ভরসার জায়গা হয়ে ওঠেন এবং সে সময় ব্রিটিশ সরকার জমিদার প্রথা চালু করলে কৃষ্ণচরণ শাহ ও আনন্দ সাহার দুই পুত্র করোটিয়া ২৪ পরগনার জমিদারের কাছ থেকে জমিদারের একটি অংশ বিপুল অর্থের বিনিময়ে কিনে নেন , আর এর মধ্য দিয়ে এ মহেড়া গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় মহেড়া জমিদারী ।
সুবিশাল এই প্রাসাদটিতে প্রবেশের জন্য রয়েছে প্রধান দুটি ফটক , এবং এই প্রধান ফটকের সামনেই রয়েছে বিশাখা সাগর নামে বিশাল একটি দীঘি । এই প্রধান ফটকের পথ ধরে ভিতরে প্রবেশ করলে আপনার চোখে পড়বে চৌধুরী লজ ,আনন্দ লজ , মহারাজ লজ ও কালীচরণ লজ নামে চোখ জুড়ানো চারটি প্রাসাদ এছাড়াও এই জমিদারের সুবিশাল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য রয়েছে নায়েব ভবন কাছারি ভবন সহ বেশ কিছু স্থাপনা ।
ভিতরে প্রবেশের মুখে যে প্রাসাদটি রয়েছে সেটির নাম চৌধুরী লজ , রোমান শৈলীতে নির্মিত এই চৌধুরী লজের পিলারগুলো বাইরের দিকে অতন্ত্র প্রহরীর নেয় দাঁড়িয়ে আছে । চমৎকার নকশা খচিতো এই প্রাসাদটির ভিতরে রয়েছে ঢেউ খেলানো ছাদ । কালের বিবর্তনে এই প্রাসাদটি গোলাপি রং ছেড়ে সাদা রং কে আপন করে নিয়েছি । জমিদার বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভবন হল আনন্দ লজ , এ প্রাসাদের সামনের বিশাল বাগান ও তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ করবে সবাইকে, প্রাসাদের সামনে আটটি কলামের উপর ঝুলন্ত বারান্দা রয়েছে যা খুবই অসাধারণ ও আকর্ষণীয় ।বাইজেন্টাইন শৈলীতে নির্মিত মহারাজ লজের সামনে রয়েছে ৬টি কলাম । মহারাজ লজের সামনের বাঁকানো সিঁড়ি এই ভবনের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে দিয়েছে এছারাও এই ভবনে রয়েছে বারোটি সুবিশাল কক্ষ । জমিদারের শেষ সময় তৈরি করা কালীচরণ লজ অন্য সকল ভবন থেকে আলাদা এবং অন্য ভবন গুলোর চেয়ে এই ভবনের কক্ষ সংখ্যাও বেশি, ইংরেজি ইউ আকারে নেয় নির্মিত এই ভবনটির ভিতরে বিকেলের রোদে আলো-আঁধারের এক আসাধারন খেলা দেখা যায় । এছাড়াও মোগল এই জমিদার বাড়িতে রয়েছে নায়েব ভবন, কাচারি ভবন সহ নান্দনিক রানীমহল।
জমিদার ও তার উত্তরসূরীরা শুধু যে বৃত্ত বৈভবের মালিক ছিল তাই শুধু নয় তারা ছিলেন জনসাধারণের সুচিন্তক , সৌখিন ও স্বাধীনচেতা , সে এলাকার মানুষের কথা চিন্তা করে তারা নির্মাণ করেছেন বিদ্যালয়, মন্দির, সুপেয় পানির দীঘি , শ্মশান , ওষুধি গাছ রোপন , বাগান তৈরি সহ আরো বেশ কিছু স্থাপনা । দু ভাইয়ের হাত ধরে গড়ে ওঠা মহেড়া জমিদার বাড়ির জমিদারি ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় স্বপ্নাকাশে ।
তবে জনগণ ও প্রজাদের প্রতি সদয় এই জমিদার বাড়িটিতে এসেছিল একটি কালো অধ্যায় সে অধ্যায়ের পথ ধরে জানা যায় ১৯৭১ সালের ১৪ ই মে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী এই মহেরা জমিদার বাড়িতে হামলা করে এবং জমিদারবাড়ির বধু কুল যোগমায়া চৌধুরীসহ যোগমায়া রায়চৌধুরী সহ ৫ জন গ্রামবাসীকে চৌধুরী লজ এর মন্দির এর পেছনে একত্রে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে ইতিহাসের এই কলঙ্কিত ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে মহেরা জমিদার বড়ির ইট পাথরগুলো ।
মহেড়া জমিদার বাড়ির জমিদাররা , যে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য সর্বক্ষণ ব্যস্ত হয়ে থাকতেন সেই দেশের মাটিতে এমন নির্মম পরিণতি সেসময়ের জমিদার কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি , শতবছরের সাজানো জমিদারবাড়ি আর প্রচুর অর্থ সম্পদ সেরে তৎকালীন জমিদার রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী সপরিবারে কলকাতায় চলে যান ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর এই জমিদার বাড়ি পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ,এরপর ১৯৯০ সাল থাকে এখন পযন্ত এই ভবনগুলো পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে ।স্পেন স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন এই মহেরা জমিদার বাড়ি এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বিরাজ করছে প্রতিটি টাঙ্গাইল বাসির মধ্যে , নিখুঁত কারুকাজ ও নান্দনিকতায় ঘেরা এই মহেরা জমিদার বাড়ি কালের বিবর্তনে তার জৌলুস এখনো যেন ধরে রেখেছে , ইতিহাসের পাতায় এমন আলো ছড়ানো জমিদারবাড়ি আরো একটি খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন । এই উজ্জ্বল আলো আরো কিছু স্মরণীয় স্মৃতি পার করত যদি না জমিদার তার চাপা কষ্ট নিয়ে রাতের আঁধারে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতেন । এই জমিদার বাড়ির প্রতিটি কক্ষে হয়তো এখনো ঘুরে বেড়ায় সেই রানী হয়তো চাপা চিৎকারে নিজের অতিতকে একটি বারের জন্য ফিরে পাতে চায় ।
১৮০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলায় সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি যা স্থানীয়দের কাছে নবাব প্যালেস বার নবাব মঞ্জিল নামে পরিচিত আমাদের পরবর্তী ভিডিওতে আপনাদের নিয়ে যাব ঢাকা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে থাকা ধনবাড়ী জমিদার বাড়িতে। আমাদের পরবর্তী ভিডিওতে জানাবো মুঘল স্থাপত্য শৈলীর এক অনন্য নিদর্শন ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি নবাব প্যালেস সম্পর্কে
আমাদের আজকের ভিডিও কেমন লাগলো তা অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন সবাই ভাল থাকবেন ধন্যবাদ ।